যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং কেনার ঘোষণার পর এবার এয়ারবাস বিক্রির জন্য জোরেশোরে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে ইউরোপের কূটনীতিকরা। গত জুলাই মাসে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িংয়ের ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার ঘোষণার পর নভেম্বরে ইউরোপের কূটনীতিকরা আটঘাট বেঁধে নেমেছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও সরাসরি এয়ারবাসের বিষয়ে আলাপ করেছেন কূটনীতিকরা। এয়ারবাস ঘিরে কূটনীতিকদের চাপ দৃশ্যমান হলেও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কোন চাপ আছে বলে মানতে নারাজ।
চলতি বছরের জুলাই মাসে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত বছর বোয়িং কেনার জন্য কূটনীতিক তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে। ওই বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে জুলাইয়ে সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের সঙ্গে বোয়িং কেনার বিষয়ে বৈঠক করেন তিনি। বৈঠক শেষে বিমান মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, বোয়িং না এয়ারবাস—কোন কোম্পানির উড়োজাহাজ কেনা হবে, তা নির্ভর করছে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর। মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিমানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বন্ধুত্ব, অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উড়োজাহাজশিল্পের অংশীদার হওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর আগ্রহ রয়েছে। তবে ঢাকার কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর সেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন আর পাওয়া যায়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পর দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আবারও আলোচনায় আসে বোয়িং কেনার বিষয়টি। দুই দেশের আলোচনার মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা আসে বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ কেনার।
এই ঘোষণার ঠিক তিন মাস পর ঢাকায় গত ৪ নভেম্বর এয়ারবাস নিয়ে ‘বাংলাদেশের এভিয়েশন গ্রোথ’ শীর্ষক এক আলোচনার আবির্ভাব ঘটে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, ক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যঁ-মার্ক সেরে-শার্লে, জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ এবং এয়ারবাসের কমার্শিয়াল সেলস ডিরেক্টর (চিফ রিপ্রেজেনটেটিভ, বাংলাদেশ) রাফায়েল গোমেজ।
অনুষ্ঠানে কূটনীতিকরা উড়োজাহাজ খাতে ব্যবসায় স্বচ্ছতা ও বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ চেয়েছেন। ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‘আমি এ দেশে এয়ারবাসের উপস্থিতির বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে জোর দিচ্ছি। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, স্বচ্ছতা এবং বৈষম্যহীনতার দীর্ঘদিনের আশ্বাস পূরণ করে এটিকে যেন বিমানের বহরকে আধুনিকীকরণ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ দেশের উড়োজাহাজ খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত।’’কূটনীতিক সুত্রে জানা গেছে, বোয়িং বাংলাদেশকে ২৫টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিল, আর এয়ারবাস দিয়েছে ১৪টি।
এয়ারবাস নিয়ে আলোচনা সেখানেই থেমে যায়নি। রাষ্ট্রদূতরা সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) এয়ারবাস নিয়ে আলাপ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মার্ক সেরে শার্লে। তিনি ঢাকার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন গত সেপ্টেম্বরে। ঢাকায় আসার পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
আলোচনায় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সরকারের সাফল্যের প্রশংসা করেন। এর পাশাপাশি তিনি কাঠামোগত সহযোগিতার ওপর জোর দেন। তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বস্ত এবং এলডিসি উত্তরণের পর দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে পাশে চায় বলেও জানান। এক্ষেত্রে কাঠামোগত সহযোগিতার কথা তুলে ধরে, সিভিল এভিয়েশন খাতে এয়ারবাসের দেওয়া প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তিনি জানান— এই উদ্যোগ বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পৃক্ততা ধরে রাখবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এয়ারবাস বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গটি মঙ্গলবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে গত বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত অনুষ্ঠান ‘ডিক্যাব টকে’ এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. রুডিগার লোটজ বলেছেন, এয়ারবাস নিয়ে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, এর পেছনে আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন- জিএসপি সংক্রান্ত আলোচনা— এগুলো কাউকে হুমকি দেওয়ার বিষয় নয়, মোটেও না। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত সিদ্ধান্তগুলো আংশিকভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তাই জিএসপি প্লাস আলোচনার অগ্রগতি বা সিদ্ধান্ত, এয়ারবাস নিয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে ঘিরে সামগ্রিক পরিবেশে প্রভাব ফেলে। তবে বাণিজ্যিক একটি সমঝোতার কারণে সার্বিক সম্পর্ক নির্ভরশীল নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। জার্মান রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আজ একথা জানান।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমি মনে করি না, এই বাণিজ্যিক একটি সমঝোতার ওপরে আমাদের সার্বিক সম্পর্ক নির্ভরশীল হবে। অবশ্যই রাষ্ট্রদূত চেষ্টা করবেন, যেন তার দেশের যে ব্র্যান্ড আছে সেটা বিক্রি হয়। এটা স্বাভাবিক, এটা তার দায়িত্ব। আমি মনে করি, তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এটা আমি একেবারে মনে করি না যে, একটা বাণিজ্যিক সমঝোতা— যেটা বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি এবং আমাদের যে ফ্রিকড সাইজ, তাতে করে আমাদের জন্য কোনটা সুবিধা হবে— সেটা আমাদের বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। এ বিষয়ে সরকারের ওপর কোনও চাপ আছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি অন্তত অনুভব করছি না। বাকিটুকু যিনি কিনবেন তাকে জিজ্ঞাসা করেন। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি ইউরোপের প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারবে, নাকি ফিরিয়ে দেবে?
ঢাকায় একজন সাবেক কূটনীতিক এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, কূটনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলে তা আত্মঘাতী হতে পারে। এখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের এভিয়েশন খাতে এয়ারবাস নতুন বিষয়। সুতরাং, সক্ষমতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে, কোনও চাপে নয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
বোয়িংয়ের পর এয়ারবাস কেনা নিয়ে কূটনীতিকদের চাপ
- আপলোড সময় : ২৮-১১-২০২৫ ০৩:৩৫:২৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৮-১১-২০২৫ ০৩:৩৫:২৪ অপরাহ্ন
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
স্টাফ রিপোর্টার